Home কিশোরগঞ্জ ছেলে শহীদ হয়েছে, এটাই আমার গর্ব

ছেলে শহীদ হয়েছে, এটাই আমার গর্ব

2

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে যান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর চলে যাওয়ার খবরে সারা দেশে রাজপথে নেমে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে সর্বস্তরের মানুষ। সারা দেশের মতো সেদিন গাজীপুরেও বিজয় মিছিলে অংশ নেন স্থানীয়রা। শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ২ নম্বর সিএনবি এলাকায় মিছিলে যোগ দেন দশম শ্রেণির ছাত্র মুহাম্মদ শিফাত উল্লাহ। তবে সেই মিছিল থেকে আর ঘরে ফেরা হয়নি তাঁর। বিক্ষোভকারীদের ওপর বিজিবির গুলিতে শহীদ হন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিক্ষোভকারীদের সরাতে সেদিন বিজিবি মুহুর্মুহু গুলি চালায়। তাদের ছোড়া গুলিতে নিহত হন ছয়জন। আহত হন শতাধিক মানুষ।

আসরের নামাজের পর সহপাঠী ও আন্দোলনকারীরা রাস্তায় শিফাতের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখেন। পরে সহপাঠীরা মরদেহটি হাসপাতালে নিয়ে যান।

মাগরিবের পর শিফাতের বাবার কাছে ফোন করা হয়। জিজ্ঞেস করা হয়, ‘আপনি কি শিফাতের বাবা?’ ‘হ্যাঁ’ বলতেই ছেলের মৃত্যুসংবাদ শুনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি।

শিফাতের জন্ম ২০০৫ সালের ১২ নভেম্বর। গাজীপুরের জামিয়া ইসলামিয়া এমদাদুল উলুম এতিমখানা ও মাদ্রাসার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন তিনি। তাঁর বাবা কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের মুনিয়ারীকান্দা গ্রামের হাফেজ মাওলানা নুরুজ্জামান। ছেলেকে নিয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন তিনি।

তাঁর ভাষায়, ‘আমি শহীদ হয়েও যদি ছেলেটা বেঁচে থাকত। কেউ যদি সারা পৃথিবীর প্রেসিডেন্টও বানিয়ে দেয়, এই যন্ত্রণা কি শেষ হবে? তবে আমার ছেলে শহীদ হয়েছে, এটাই আমার গর্ব।’

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে মাওলানা নুরুজ্জামান বলেন, ‘দাফনের কয়েক দিন পর মাওনা যাই। স্থানীয়দের কাছে জানতে পারি, বিজিবি সদস্যরা আটকা পড়েছিল, পরে চলে যাওয়ার সময় এলোপাতাড়ি গুলি করে। তখনই শিফাত গুলিবিদ্ধ হয়। ওই দিন ১১টার পরে, দুপুরে, এমনকি আসরের নামাজের সময়ও গুলি চলেছে। ছেলের মরদেহ পড়ে ছিল রাস্তায়। সহপাঠীরা তাকে শনাক্ত করে। মাগরিবের পর মাদ্রাসার শিক্ষক ফোন করে জানালে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। পরে ছোট ভাই ও ভাতিজারা খবর নিয়ে রাতেই মাওনা যায়। সেখান থেকে রাত ২টার দিকে মরদেহ বাড়ি আনা হয়। পরদিন সকালে ঈদগাহ মাঠে জানাজা হয়, বেলা ১১টায় দাফন করি।’

ছেলের স্মৃতিচারণা করে মাওলানা নুরুজ্জামান আরও বলেন, ‘করোনার সময় শিফাত আমাকে বলে, আব্বা আমার স্বপ্ন একটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করার। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বাবার কাছ থেকে পাওয়া সম্পদ বিক্রি করে একটা মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করি। প্রথমে নিজের বাড়িতে শুরু করি। বাড়িতে ছয় মাস চালানোর পর জমি বিক্রি করে ১৮ শতাংশ জায়গা কিনে সেখানে মাদ্রাসার কার্যক্রম শুরু করি। শিফাতকে হারানোর পর থেকে আমার ও তাঁর আম্মার কিছু মনে থাকে না। এখন আর কোনো কাজের স্পৃহা নাই। তবে যখন মাদ্রাসার ছাত্রদের পড়াই, তখন একটু ভালো লাগে।’

মাওলানা নুরুজ্জামান জানালেন, সরকার, জেলা প্রশাসন, জুলাই ফাউন্ডেশন ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে প্রায় ১৮ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন। তা দিয়েই এখন তাঁদের সংসার চলে।

শিফাত উল্লাহর বড় ভাই হিযবুল্লাহ বলেন, ‘ভাই আমার বন্ধুর মতো ছিল। তার পরিশ্রমে এই মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। তাকে হারানোর পর থেকেই আমরা যন্ত্রণা ভোগ করছি। আর যারা ফ্যাসিস্টদের সঙ্গে যুক্ত, তারা আমাদের বিরক্ত করে।’

কিশোরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সংগঠক আশরাফ আলী সোহান বলেন, ‘হাফেজ শিফাত আমাদের গর্ব। সব সময় আমরা তার পরিবারের পাশে থাকব ইনশা আল্লাহ।’

পাকুন্দিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. বিল্লাল হোসেন বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী শহীদ শিফাত উল্লাহর পরিবারকে আমরা সব সময় সহযোগিতা করে যাচ্ছি। এরই মধ্যে শহীদ পরিবারের বাড়ি পর্যন্ত পাকা রাস্তা করে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতেও সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা থাকবে।’

NO COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here